শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩২ পূর্বাহ্ন

জোটন সিন্ডিকেটের অবৈধ উচ্ছেদ বানিজ্য !

  • প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৩
  • ১৮৫ বার পঠিত

আশিক নূরঃ

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দেয়ালে দেয়ালে সাবধান বাণী। ‘দুর্নীতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ ‘দুর্নীতি করব না, দুর্নীতি সইব না।’ আরও কত কী নীতিকথা। কিন্তু কে শোনে কার কথা। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। বাস্তবতা হলো এখানে ঘুসের লেনদেন ছায়াসঙ্গীর মতো।
আরও সহজ করে বললে বলতে হবে-ঘুসের ওপেন হাট। এর ফলে রাজউকে ঘুস ছাড়া ফাইল রিলিজ করা অনেকটা সাঁতার না জেনে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতো অবস্থা হবে। পরতে পরতে ঘুসের রেট বাঁধা। প্যাকেজ রেটে ঘুস আদায়ের বহু পুরনো পদ্ধতি এখনো চালু। সম্প্রতি সারা দিন রাজউকের বিভিন্ন শাখায় ঘুরে অবিশ্বাস্য চিত্র দেখা যায়। সকাল থেকেই জোন-৬ শাখার প্রায় সব কর্মকর্তাকে মহাব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। কারও যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। সবাই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই এবং সই-স্বাক্ষরে ব্যস্ত। আবার টেবিলে টেবিলে নিচু স্বরে কথাবার্তাও হচ্ছে। পরিবেশ অনেকটা গ্রাম্য হাটের মতো। জোন ৬/১ এর অথরাইজড অফিসার জোটন দেবনাথের কক্ষের সামনে একটু পরপরই দর্শনার্থী আসছেন। তিনি অনুপস্থিত বাহিরে মিটিংয়ে গিয়েছেন। ফলে কক্ষটি বন্ধ। তাকে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন সেবাপ্রার্থীরা। এর মাঝে দুজন লোক পরিচয় জানতে চান। তাদের প্রশ্ন-কী কাজে এসেছেন দ্রুত বলে ফেলেন। এখানে অযথা ভিড় করা যাবে না। অনুসন্ধানে জানা যায় , রাজউক জোন ৬/১ এর অথরাইজড অফিসার জোটন দেবনাথের দূর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে পদে পদে ক্ষুন্ন হচ্ছে রাজউকের ভাবমূর্তি ও বিচ্যুত হচ্ছে রাজউকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। রাজউক জোন-৬/১ এর উচ্ছেদ কার্যক্রমের পুরোটাই জোটন বানিজ্যে রূপান্তরিত করেছেন। প্রতিটি উচ্ছেদ কার্যক্রম হয়ে ওঠে এক একটি চাঁদ রাত। চাঁদ রাতের সফলতা ঘরে তুলতে তিনি রাজউকে গড়ে তুলেছেন প্রধান ইমারত পরিদর্শক ইমরান হোসেনের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটে রয়েছে বেশ কিছু পরিদর্শক, রাজনৈতিক পরিচয় বহনকারী কিছু নেতা, উর্ধতন ২/১ জন কর্মকর্তা ও কিছু দালাল চক্র। উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার সময় তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা অত্র এলাকার অন্যান্য ভবন থেকে উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করে থাকেন। এছাড়া ভবন কম ভাঙতে করেন ঘুস বানিজ্য। উচ্ছেদের তালিকায় থাকা এমনও ভবন রয়েছে যেগুলো প্রকৃতপক্ষে উচ্ছেদ করা হয়নি অথবা গুতো দিয়ে খুবই সামন্য ভাঙা হয়েছে। কিন্তু দায় এড়াতে তিনি তিনশত টাকার নন-জুডিশিয়াল ষ্ট্যম্পে অঙ্গীকারনামা নেন এই মর্মে যে, ভবন মালিক বা ডেভেলপার নিজ খরচে ভবনটির অনিয়মিত অংশগুলো ভেঙে ফেলবে। কিন্তু অপকৌশলের আশ্রয় হিসেবে এই সিন্ডিকেট ইউটিলিটি বিচ্ছিন্ন করে মিটার নিয়ে আসেন রাজউকে। পরের দিন থেকে চলে সিন্ডিকেটের সদস্যদের মাধ্যমে ঘুসের দেনদরবার। কাঙ্খিত চাহিদা পূরণ হলেই পেয়ে যান ইউটিলিটি সংযোগের সুপারিশ ও মিটার। নিয়ম অনুযায়ী অনিয়মিত অংশগুলো না ভেঙে ইউটিলিটি সংযোগ পাবার কথা নয়। সংযোগ পেয়েই জোটন সিন্ডিকেটের যোগসাজশে ভবনের অনিয়মিত অংশগুলো না ভেঙে চলে জোড়াতালির কাজ। এভাবেই রাজধানীর একটি বিশাল এলাকায় শতশত ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে জোটন সিন্ডিকেটের আশীর্বাদে। রাজউক জোন-৬/১ এ সরেজমিনে অনুসন্ধান করলে জোটন সিন্ডিকেটের এসব অপকর্মের ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। এছাড়া তিনি নকশা বহির্ভূত বিভিন্ন ভবনে নোটিশ প্রদান করেন একটি, দুইটি, তিনটি, কখনো চুড়ান্ত নোটিশ। ৪ টি ধাপের যেকোনো ধাপে পড়ে যায় ফাইল ধামাচাপা। নেয়া হয়না আর কোন ব্যবস্থা। এমনকি উচ্ছেদ প্রস্তাব পাশ হবার পড়েও ফাইল ধামাচাপার নজির রয়েছে এই সিন্ডিকেটের। এছাড়া নকশা না নিয়ে বহুতল বানিজ্যিক ভবন, আবাসিকের নকশায় বানিজ্যিক ভবন, এমনকি নকশায় অনুমোদিত তলার চেয়ে বেশি তলা করার সহযোগিতা করে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন এই সিন্ডিকেট। অবশ্য জোটন সিন্ডিকেটের গ্রাহক হয়রানি ও বানিজ্য শুরু হয় ছাড়পত্র ও নকশা আবেদনের পর থেকেই। বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে যেমন কাগজপত্রে ঠুনকো সমস্যা, জমির পাশে রাস্তা কমবেশি, ড্যাপের ঝামেলা ইত্যাদির অযুহাত দেখিয়ে মাসের পর মাস ফাইল আটকে রেখে গ্রাহক হয়রানি করে সিন্ডিকেটের সদস্যদের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন জোটন। এসব বিষয়ে ইতিপূর্বে বিভিন্ন গণমাধ্যমে “রাজউকের উচ্ছেদ কার্যক্রম ফলাফল শূন্য”, “কমার্শিয়াল ভবন নির্মাণ আবাসিকের নকশায়”, “নকশা না নিয়ে বহুতল বানিজ্যিক ভবন”, অর্থ ও “ক্ষমতার দাপটে আড়াল থেকে যায় ফাইল” ইত্যাদি শিরোনামে অসংখ্য সংবাদ প্রকাশিত হলেও খাতা-কলমে লোক দেখানো ব্যবস্থা ছাড়া বাস্তবে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি জোটন। বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে জোটন দেবনাথের সাথে কথা বলতে তার অফিসে গেলে তিনি বলেন, রাজউকে নিয়ম হয়েছে আমরা মিডিয়ায় কোন বক্তব্য দিতে পারবো না। মিডিয়ার সাথে কথা বলবেন নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম। আশরাফুল ইসলামের কাছে জোটনের বিভিন্ন অপকৌশল ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা ও উচ্ছেদের পর ভবন জোড়াতালির সহযোগিতা, দায়িত্বে অবহেলা হয়েছে কি-না? উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই দায়িত্ব অবহেলা হয়েছে। গ্রাহক হয়রানি, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঘুস বানিজ্য ও দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে জোটন দেবনাথের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিয়ার মোবাইলে ফোন করলে তিনি ফোন ধরেননি। পরবর্তীতে ক্ষুদে বার্তা দিয়েও জোটনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের ব্যপারে জানা যায়নি।

Facebook Comments Box
এই জাতীয় আরও খবর